মো: আবু সুফিয়ান : বাংলাদেশের প্রধান কয়েকটি সমস্যার মধ্যে শব্দদূষণ অন্যতম । এটি একটি নিরব ঘাতক। আর রাজধানীর শহর থেকে শুরু করে ছোট-বড় মফস্বল শহরগুলোতে এই নিরব ঘাতকের শিকার প্রতিটি মানুষ।
ঢাকা শহর হলো- বিশ্বের সবচেয়ে কোলাহলপূর্ণ শহরগুলোর মধ্যে অন্যতম। রাজধানীর বেশির ভাগ মানুষই শব্দ দূষণের শিকার।আন্তর্জাতিক সংস্থা দুটোর শব্দের মানমাত্রার তালিকা অনুযায়ী রাজধানীতে সবচেয়ে নিরব অঞ্চলটির শব্দও রয়েছে অসহনীয় পর্যায়ে। সহনীয় মাত্রার চেয়ে বেশি শব্দ দূষণের ফলে মারাত্মক ঝুকিপূর্ণ পর্যায়ে পৌঁছেছে শহরটি। প্রতিনিয়ত এর মত্রা যেন বেড়েই চলেছে। শিশু থেকে বৃদ্ধ এই নিরব ঘাতকের শিকার প্রতিটি মানুষ।এর নিয়ন্ত্রণে কার্যকর উদ্যোগও তেমন নেই। যার দরুন বেপরোয়া গতিতে যেন প্রতিনিয়তই ভয়ানক রূপ নিচ্ছে এই নিরব ঘাতক।ঢাকা যেন এরই বাস্তব রূপ।
আগে রাজধানীতে গড়ে ১২ ঘণ্টা সময় ধরে সহনীয় মাত্রার চেয়ে বেশি মাত্রায় শব্দদূষণ হতো। এখন তা ১৪ ঘণ্টা ছাড়িয়ে গেছে।
শব্দদূষণ (নিয়ন্ত্রণ) বিধিমালা ২০০৬ অনুযায়ী, ঢাকার জন্য দিনের বেলায় শব্দের আদর্শ মান (সর্বোচ্চ সীমা) ৬০ ডেসিবেল। দেশের বিভাগীয় শহরগুলোতে শব্দের মানমাত্রা ১৩০ ডেসিবেল ছাড়িয়ে গেছে। যা স্বাভাবিক মাত্রার চেয়ে আড়াই থেকে তিনগুণ বেশি।
গত জানুয়ারি মাসে ক্যাপস ( বায়ুমণ্ডলীয় দূষণ অধ্যয়ন কেন্দ্র ) এর একটি গবেষণায় দেখা যায়,, ঢাকার দুই সিটি করপোরেশনে শব্দের তীব্রতা মানমাত্রা ছাড়িয়েছে। নগরের বিভিন্ন স্থানে সাধারণভাবে শব্দের গ্রহণযোগ্য মানমাত্রার থেকে প্রায় ১ দশমিক ৩ থেকে ২ গুণ বেশি শব্দ পাওয়া গেছে।
ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন এলাকায় শব্দের গড় মাত্রা পাওয়া গেছে ৭৬ দশমিক ৮০ ডেসিবেল। যে তিনটি সড়কের সংযোগস্থলে সর্বোচ্চ মাত্রার শব্দদূষণ পাওয়া গেছে, সেগুলো হলো নিউমার্কেট মোড়, নয়া পল্টন মোড় এবং প্রেসক্লাব মোড়। সেখানে শব্দদূষণের মাত্রা যথাক্রমে ১০০ দশমিক ৬৫ ডেসিবেল, ৯২ দশমিক ২২ ডেসিবেল এবং ৯০ দশমিক শূন্য ৩ ডেসিবেল। দক্ষিণ সিটির সড়কের সংযোগস্থলে অপেক্ষাকৃত কম মাত্রার শব্দদূষণ পাওয়া জায়গাগুলো হলো আবুল হোটেল মোড়, দৈনিক বাংলা মোড় এবং জিরো পয়েন্ট মোড়। এই তিন এলাকায় শব্দদূষণের মাত্রা যথাক্রমে ৭৮ দশমিক ২৭ ডেসিবেল, ৭৭ দশমিক ৯২ ডেসিবেল এবং ৭৭ দশমিক ৬০ ডেসিবেল।
গবেষণায় ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনে শব্দের গড় মাত্রা পাওয়া গেছে ৮০ দশমিক ৫৬ ডেসিবেল। যে তিনটি সড়কের সংযোগস্থলে সর্বোচ্চ মাত্রার শব্দদূষণ পাওয়া গেছে, সেগুলো হলো মোহাম্মদপুর বাসস্ট্যান্ড মোড়, শিয়া মসজিদ মোড় এবং মাসকট প্লাজা মোড়। এসব স্থানে শব্দদূষণের মাত্রা যথাক্রমে ৯৯ দশমিক ৭৭ ডেসিবেল, ৯৩ দশমিক শূন্য ৫ ডেসিবেল এবং ৯০ দশমিক ২৭ ডেসিবেল। উত্তর সিটির যেসব সড়কের সংযোগস্থলে অপেক্ষাকৃত কম মাত্রার শব্দদূষণ পাওয়া গেছে সেগুলো হলো মিরপুর বেড়িবাঁধ মোড়, রবীন্দ্র সরণি মোড় এবং গুলশান-২ মোড়। এসব স্থানে শব্দদূষণের মাত্রা যথাক্রমে ৭৪ দশমিক ৮৬ ডেসিবেল, ৭৫ দশমিক ২৫ ডেসিবেল এবং ৭৬ দশমিক শূন্য ১ ডেসিবেল।
শব্দদূষণ রোধে দেশের প্রচলিত আইন যর্থার্থ থাকলেও তা প্রয়োগের দুর্বলতা, সাধারণ মানুষের মধ্যে শব্দদূষণের কুফল সম্পর্কে সচেতনতা না থাকার কারণে এই সঙ্কট আরও তীব্র আকার ধারণ করছে। সরকারি সংস্থাগুলোর সমন্বিত উদ্যোগের অভাব, আইন প্রয়োগের দুর্বলতা এবং রাজনৈতিক প্রভাবের কারণে শব্দদূষণ রোধ কোনো ভাবেই রোধ করা যাচ্ছে না । রাজধানীতে প্রতিদিন হাজারো শব্দের প্রাদুর্ভাব ঘটছে।মানুষের তৈরি শব্দ দূষণ থেকে প্রকৃতিক ভাবেও শব্দ দূষণ হচ্ছে। প্রাকৃতিকভাবে সৃষ্ট শব্দের চেয়ে মানুষের তৈরি সৃষ্ট শব্দের সংখ্যাই সবচেয়ে বেশি। শব্দ দূষণের বিভিন্ন উল্লেখযোগ্য কারণ রয়েছে। তবে ঢাকায় বহিরঙ্গন শব্দের মূল করণ যানবাহন।
যানবাহনের উৎপন্ন শব্দ মারাত্মক প্রভাব ফেলেছে রাজধানীসহ সারা দেশেই। বাস, ট্রাক, ট্রেন,মটর সাইকেল, ব্যাটারিচালিত অটোরিকশা ইত্যাদি। যেকোনো ইঞ্জিন চালিত যানবাহনের অতিরিক্ত শব্দের ফলে শব্দ দূষণ হয়। তাছাড়া এগুলোর বিরামহীন হর্ণও শব্দ দূষণের অন্যতম কারণ। তবে শুধুই স্থলপথেই থেমে থাকে না এই নীরব ঘাতক। আকাশ চালিত যুদ্ধ বিমান, হেলিকপ্টার, সাধারণ বিমান ইত্যাদি তীব্র গতি সম্পন্ন বাহনের প্রচন্ড আওয়াজ শব্দ দূষণের অন্যতম কারণ।
তবে রাজধানীতে শুধু যানবাহনই শব্দ দূষণের প্রধান সমস্যা না।আরও বেশ কয়েকটি উল্লেখযোগ্য কারণ রয়েছে। তাদের মধ্যে কল-কারখানার নির্গত বিকট শব্দ দূষণের অন্যতম কারণ।
রাজধানীসহ ঢাকার বিভিন্ন স্থানে বড় বড় দালান-কোঠা কিংবা বিভিন্ন নির্মাণকার্য প্রস্তুতের সময় ভারী যন্ত্রপাতি ব্যবহার করা হয় যার থেকে বিকট আওয়াজের সৃষ্টি হয়, যা আশেপাশে ব্যাপক শব্দ দূষণ ঘটায়।
রাজনৈতিক সভা, সমাবেশ, মিছিল, মিটিং, বিয়ের অনুষ্ঠান, হাটবাজারসহ বিভিন্ন সামাজিক অনুষ্ঠান প্রভৃতি জায়গায় মাইক, রেডিও ও বিভিন্ন বাদ্যযন্ত্রের ব্যবহারে ফলে শব্দ দূষণ ঘটে।বাদ্যযন্ত্রের ড্রামের আওয়াজেও শব্দ দূষণ ঘটে।
তবে মানুষের তৈরি শব্দের কারণেই শুধু শব্দ দূষণ হয় না বিভিন্ন প্রাকৃতিক কারণেও শব্দ দূষণ হয়।যেমন,বিভিন্ন সময় বৃষ্টিপাতের সাথে মেঘের গর্জন ও বজ্রপাতের ফলে বিকট আওয়াজ হয় যা শব্দ দূষণ ঘটায়,ভূমিকম্পের ফলে সৃষ্ট কম্পনের ফলেও শব্দ দূষণ ঘটে ইত্যাদি।
শব্দ দূষণের ফলে রাজধানীসহ প্রধান শহরগুলোর অধিবাসীদের প্রতিনিয়তই নরব মৃত্যু ঘটছে। শব্দ দূষণের ফলে নানা ধরনের স্বাস্থ্য ঝুঁকি হয়ে থাকে।এই নিরব ঘাতক মানব দেহের উপর মারাত্মক প্রভাব ফেলে।
মানবদেহর উপর শব্দ দূষণের প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ উভয় প্রকার প্রভাব পরিলক্ষিত হয়। বিরক্তিকর হওয়ার পাশাপাশি শারীরিক ও মানসিক দিক থেকে ক্ষতি করে থাকে।
কানের স্বাভাবিক ধারণ ক্ষমতা ১-৭৫ ডেসিবল। এর অধিক শব্দ হলে কানের শ্রবণশক্তি ধীরে ধীরে হ্রাস পায়। দীর্ঘদিন ধরে এ ধরনের উচ্চ শব্দ শ্রবণ করলে বধির হয়ে যেতে পারে। শব্দ দূষণের ফলে মানুষের স্মৃতিশক্তি হ্রাস পেতে পারে এবং মেজাজ খিটখিটে হওয়ার সম্ভাবনা থাকে।স্নায়ুযন্ত্রের উপর চাপ পড়ে যা পরবর্তীতে মানব দেহের বিভিন্ন অঙ্গ যেমন- রক্তসংবহন তন্ত্র, শ্বসনতন্ত্র এবং বিভিন্ন গ্রন্থির উপর প্রভাব ফেলে।
তবে শিশুদের উপর এর প্রভাব মারাত্মক। অধিক শব্দ দূষণযুক্ত এলাকায় বসবাস করলে শিশুদের দৈহিক বিকাশ বাধাগ্রস্ত হয়। ফলে শিশু বধির হয়ে যেতে পারে এবং মানসিক বিকাশ বিঘ্ন হতে পারে।
শব্দদূষণ আমাদের দৈনন্দিন জীবনে এক নীরব হুমকি। এটি কেবল শ্রবণক্ষমতার ক্ষতি করে না, বরং আমাদের মানসিক স্বাস্থ্য, ঘুম ও মনোযোগের ওপরও গভীর প্রভাব ফেলে। তাই শব্দদূষণ রোধে সচেতনতা গড়ে তোলা, আইন বাস্তবায়ন, জনসচেতনতা বৃদ্ধি এবং পরিবেশবান্ধব প্রযুক্তি ব্যবহার অত্যন্ত জরুরি। নিজ নিজ জায়গা থেকে আমরা যদি সচেতন হই এবং প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ করি,তবে শব্দ দূষণ হ্রাস করে একটি সুস্থ ও শান্তিপূর্ণ পরিবেশ গড়ে তোলা সম্ভব। শব্দহীন একটি সুন্দর পৃথিবীর জন্য এখন থেকেই আমাদের এগিয়ে আসতে হবে।
Reporter Name 









